মানুষ এবং অণুজীব নিবিড় সম্পর্ক
মনুষ্য প্রজাতির সদস্য হিসেবে সবাই নিজেকে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তি বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। আক্ষরিক অর্থে একজন মানুষ বলতে শুধু কি ব্যক্তিকেই বোঝানো হয়ে থাকে? অর্থাৎ একেকজন মানুষ মানেই কি একেকজন পৃথক ব্যক্তি? জীববিজ্ঞানের দিক থেকে মানুষ বা হিউম্যান বিং বলতে একা একজন মানুষকেই নির্দেশ করা হয় না। এখানে একা বিষয়টি ঠিক প্রচলিত একাকীত্বের সাথে সম্পর্কিত না। অর্থাৎ মানুষ বাস্তবিকপক্ষে কখনোই একা নয়। মানুষের দেহের মাঝেই রয়েছে কোটি কোটি অণুজীবের নিত্য বসবাস এবং মজার বিষয় হচ্ছে যে দৈবচয়নে যেকোনো দুইটি অণুজীবের প্রজাতিকে নিয়ে চিহ্নিত করতে গেলেও দেখা যাবে যে তারা একটি অপরটির তুলনায় ভিন্ন। অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতিতে যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, শুধু একজন মানুষের দেহের অণুজীবের মাঝেই তার চেয়ে অধিক বৈচিত্র্য বিদ্যমান।
অনুজীবের সাধারণ চিত্রায়ন Source: biocote.com
দেহের ত্বক, ঠোঁট, মুখ গহ্বর প্রতিটি অঙ্গই অণুজীবের ভিন্ন ভিন্ন বাসস্থান হিসেবে কাজ করে থাকে। “বৈচিত্র্য মাত্রই সৌন্দর্য”- এই কথাটির সবচেয়ে সার্থক রুপায়ন বোধহয় অন্ত্রে এবং পৌষ্টিক গহ্বরে। আর দশটা প্রাত্যহিক কাজের পাশাপাশি যে কাজটা সময়মত না করলেই নয় সেটি আর কিছুই নয়- আহার। নির্দিষ্ট সময় পরপর পৌষ্টিক নালির মধ্য দিয়ে গ্রহণকৃত খাবার অন্ত্রে পৌছায় যেখানে বসবাসকারী প্রতিটি অণুজীব প্রজাতির সুনির্দিষ্ট কাজ আছে।
বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত অণুজীব Source: sitn.hms.harvard.edu
Fully funded Scholarship Lausanne University of Switzerland (Apply Now)
কিছু প্রজাতি প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাদ্যের ভাঙন ঘটায়, কিছু প্রজাতি দুগ্ধজাত দ্রব্যের পরিপাকে সাহায্য করে। অণুজীবদের মাঝে কেউ কেউ ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা ইনফ্লামেটরী বাওয়েল ডিজিজের জন্য দায়ী। সেলুলোলাইটিক ব্যাকটেরিয়ার নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে শাকসবজিতে বিদ্যমান সেলুলোজকে ভেঙে সরল শর্করাতে পরিণত করাই এদের কাজ।
শর্করার ভাঙনে অণুজীব Source: youtube.com
সরল শর্করা অণুগুলো পরবর্তীতে আরও একদলের কাছে যায় যারা তাদের কাছ থেকে শক্তি সঞ্চয় করে নেবে তাদেরকে অ্যালকোহলে রূপান্তর করার মাধ্যমে। এভাবে পরস্পর সম্পর্কিত কিছু কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে অন্ত্রে বসবাসরত অণুজীবের প্রজাতিগুলো একটি বৃহৎ সম্প্রদায় গড়ে তোলে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এটাই যে এই সম্প্রদায়ের ভেতরকার গঠন বা আদল সব মানুষের ক্ষেত্রে এক নয়।
মানবদেহে অণুজীবের প্রভাব
মানুষের দেহে অণুজীবের কার্যাদি বিভিন্ন প্রকারের। তবে সবচেয়ে বৈচিত্র্য দেখা যায় আমাদের আন্ত্রিক গহ্বর এবং পৌষ্টিক নালীতে। আন্ত্রিক অণুজীব সম্প্রদায় এবং মানুষের স্বাস্থ্যের মাঝে সম্পর্ক দিন দিন ক্রমান্বয়ে আরও স্পষ্ট হচ্ছে। বিষয়টিকে এক কথায় বলতে গেলে অনেকটা এরকমই দাঁড়ায় যে আন্ত্রিক গহ্বরের উন্নত বিন্যাস অনেকাংশেই পোষকের (এক্ষেত্রে মানুষ) সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী। সাধারণত মানুষের আন্ত্রিক অণুজীবগুলো দুইটি পর্বের সমন্বয়ে গঠিত- ব্যাকটেরয়ডিটিস এবং ফার্মিকিউটিস। একজন ব্যক্তির জীবদ্দশায় তার গ্রাসনালি থেকে শুরু করে গুহ্যদ্বার পর্যন্ত বিন্যস্ত অণুজীবগুলোর মাঝে কোথাও সাময়িক এবং কোথাও বিশেষ ধরনের বৈচিত্র্য বর্তমান থাকে। মানুষের দেহে চলমান বিভিন্ন প্রক্রিয়ার উপর যেমন পুষ্টি, ওষুধ ও জেনোবায়োটিক বিপাক, আন্ত্রিক মিউকোসাল প্রাচীরের রক্ষণাবেক্ষণ, ইমিউনোমোডুলেশন এবং বিভিন্ন পরজীবীর আক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষায় অণুজীবদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। অণুজীবের কাজের ধরণ বা তাদের বিভিন্ন প্রজাতির উপস্থিতি-অনুপস্থিতি কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে-
- শিশুর জন্মের ধরণ অর্থাৎ অস্ত্রোপচার অথবা স্বাভাবিক প্রসব
- শৈশবে খাদ্যাভ্যাস অর্থাৎ মাতৃদুগ্ধ পান অথবা অন্যান্য অনুমোদিত বিকল্প খাদ্য
- পরিণত বয়সে খাদ্যাভ্যাস অর্থাৎ খাবারে শাক-সবজি বা মাংসের উপস্থিতি
- অ্যান্টিবায়োটিকের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার
ইমিউনোলজিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে অণুজীবসমূহ দেহের কাছে পরজীবী হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং পোষক দেহ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। মজার বিষয় হচ্ছে, আন্ত্রিক অণুজীবগুলোর অধিকাংশের কোনো ধরনের পরজীবীতা নেই এবং তারা অন্ত্রের বিভিন্ন কোষের সাথে মিথোজীবী সম্পর্কে আবদ্ধ।
মস্তিষ্কের সাথে অন্ত্রে নিবিড় সম্পর্ক Source: sitn.hms.harvard.edu
Facebook is offering fellowships, paying $42,000 a year
Opportunities for Bangladeshi youth to teach in Bengali in the United States
আন্ত্রিক অণুজীবের বিভিন্ন প্রজাতি সহভোক্তা হিসেবে বেঁচে থাকে ও প্রধানত পুষ্টি, ওষুধ বিপাকের কাজে সাহায্য করে এবং সহভোজী হিসেবে এরা পরজীবীর বংশবৃদ্ধিতে বাধা প্রধান করে এবং অন্ত্রের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সাহায্য করে। পাশাপাশি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আন্ত্রিক অণুজীব প্রজাতিসমূহের সাথে একটি সহযোগিতার সম্পর্কে টিকে থাকার উদ্দেশ্যে নিজেকে অভিব্যক্ত করেছে। তবে একইসাথে এটি ক্ষতিকর পরজীবীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ গড়ে তুলতেও সক্ষম।
অণুজীব শূন্য বিশ্ব কি একচেটিয়াভাবে স্বস্তি দিতে পারবে?
কল্পনা করা যাক এমন এক পৃথিবীর কথা যেখানে কোনো অণুজীবের অস্তিত্ব নেই অর্থাৎ কোনো ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের উপস্থিতি নেই। কেমন হবে সেই পৃথিবী? আক্ষরিক অর্থেই কি তখন মানুষ নিশ্চিন্ত হতে পারবে? ইবোলা, সাধারণ ঠাণ্ডা, আলসার বা এরকম আরও অনেক অণুজীব ঘটিত রোগ থেকে মুক্তি প্রাপ্তিতে বিজয়ের উল্লাস করতে পারবে? প্রাথমিকভাবে সব ধরণের অণুজীব ঘটিত রোগকে বিদায় বলতে পারলে অবশ্যই স্বাগত জানানোর মত।
পুরো পৃথিবী জুড়ে অণুজীবের গুরুত্ব Source: archive.bio.ed.ac.uk
যদি সকল অণুজীব পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয় তাহলে পৃথিবীটা শুধু অণুজীব শূন্য হয়ে যাবে না, পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটতে থাকা অসংখ্য পরিবেশগত সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। সম্পূর্ণভাবে অণুজীব ছাড়া পরিবেশে বিভিন্ন বায়োজিওক্যামিকেল চক্রগুলো স্থগিত হয়ে যাবে এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বর্জ্য অতি দ্রুতই সঞ্চিত হতে শুরু করবে। বিভিন্ন স্বতঃস্ফূর্ত ক্যাটাবলিক এনজাইমেটিক প্রক্রিয়া ছাড়া সব ধরনের পচন বন্ধ হয়ে যাবে। জৈববস্তুপুঞ্জ বা বায়োমাসের পুনর্ব্যবহার অসম্ভব হয়ে যাওয়ার দরুন স্থলজ, জলজ উভয় পরিবেশে ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বেড়ে যাবে এবং এদের পারস্পরিক পরিবর্তন বন্ধ হয়ে যাবে। অণুজীব না থাকায় বিভিন্ন এনজাইম বা উৎসেচকের ঘাটতির কারণে সকল তৃণভোজী প্রাণিদের খাদ্য গ্রহণ এবং পরিপাক স্থগিত হয়ে যাবে। অণুজীবের অনুপস্থিতির কারণে উদ্ভিদের জীবনে নাইট্রোজেন ঘাটতি হবে এবং ফলশ্রুতিতে সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ হয়ে যাবে।
অণুজীব শূন্য পৃথিবী; Source: businessinsider.com
ব্যাকটেরিয়া এবং আর্কিয়া মুক্ত পরিবেশে পরিবেশগত, বাস্তুগত এবং মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগের ফলে যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন, সার, খাদ্যের বহুল উৎপাদন ইত্যাদির জন্য মানুষের হস্তক্ষেপ সবচেয়ে বেশি দরকার হবে। এমন অবস্থায় মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীরা সর্বোচ্চ এক শতাব্দীব্যপী টিকে থাকতে পারবে কিন্তু একটা সময় পর যেকোনো ইউক্যারিয়টের জন্যই বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
কানাডার স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়ার সহজ উপায়
প্রকৃতির সন্তান সকলেই
শুধু মানুষ নয়, অণুজীব ছাড়া পৃথিবীর জীবজগতের প্রায় পুরোটাই একটা সময় পর বিলুপ্তির সম্মুখীন হবে। বেঁচে থাকাটাই যে একমাত্র সমস্যা তা না, খাদ্য গ্রহণ এবং পরিপাকেও অণুজীবের যে অপরিসীম অবদান সেই ঘাটতি পূরণ করারও কোনো বিকল্প নেই। অণুজীব অস্তিত্বহীন হলে এর অব্যবহিত পরে হয়তো নয় অথবা শুধু একটি প্রাণও হয়তো নয় বরং দীর্ঘ সময় পরে হলেও জীবনের সন্ধান খুঁজে পাওয়া দায় হবে। অর্থাৎ অণুজীব ছাড়া জীবন খুব অল্প সময়ের জন্য সুবিধাজনক মনে হতে পারে তবে সুস্থভাবে এবং স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে হলে অণুজীবের অস্তিত্ব অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
লেখা সংগৃহীতঃ roarmedia
আরো পড়ুন, বিসিএসে অণুজীববিজ্ঞানীদের জন্য আলাদা ক্যাডার এখন সময়ের দাবী
সকল প্রকার বৃত্তির খবর সবার আগে পেতে আমাদের ওয়েবসাইটি নিয়মিত ভিজিট করুন।
Follow us on
Join our Official facebook Group