পোশাকের স্বাধীনতা মানেই অশালীনতা নয়
অসভ্য সমাজ থেকে সভ্য সমাজে রূপান্তরের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে পোশাক, কেননা আদিম অসভ্য সমাজে মানুষ পোশাক ব্যবহার করত না।
তখন পোশাক আবিষ্কার না হলেও লতাপাতা ও পশুর চামড়া দিয়ে লজ্জা নিবারণ করা হতো। এরপর পোশাকের আবিষ্কার এবং তার আধুনিকায়নের সঙ্গে পোশাক নিয়ে আসে শালীনতা।
পোশাক হয়ে ওঠে ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। কিন্তু সভ্যতার অতি আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আসে অসভ্য সমাজের মতো খাটো পোশাকের প্রচলন। যদিও পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতিতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না; হয় না সমালোচনাও, কারণ তাদের সংস্কৃতিই এমন।
বিভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে ভিন্ন পোশাকের প্রচলন রয়েছে। পোশাকের অর্থই যেখানে সভ্য বা ভদ্র সমাজের কাপড়চোপড়, সেখানে পোশাকে ভদ্রতা প্রকাশ না পেলে অসভ্য বা অশালীন পোশাক বলা যায়।
আরো পড়ুন, বিসিএসে অণুজীববিজ্ঞানীদের জন্য আলাদা ক্যাডার এখন সময়ের দাবী
গত ১৮ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী অশালীন পোশাকের কারণে রেলস্টেশনে কটূক্তি ও মারধরের শিকার হন, যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর তরুণীকে হেনস্তা ও মারধরের ঘটনায় নরসিংদীর পুলিশ ভৈরব রেলওয়ে থানায় মামলা করে এবং অভিযুক্ত মার্জিয়া আক্তার ওরফে শিলাকে ৩০ মে গ্রেপ্তার করে।
কিন্তু শিলার জামিন আবেদনের শুনানিতে আদালত থেকে জানতে চাওয়া হয়, সভ্য দেশে এমন পোশাক পড়ে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় কি না। আদালত বোঝাতে চেয়েছেন, মুসলিম দেশ হিসেবে নয়, বাঙালি সংস্কৃতিতেও অশালীনতার সুযোগ নেই।
কিন্তু সর্বত্র তরুণী হেনস্তা হওয়ার ঘটনায় আদালতের মন্তব্য প্রকাশের পর উত্তাল হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম-সহ সংবাদমাধ্যমগুলো। নারীর পোশাক প্রসঙ্গে উচ্চ আদালত শালীন পোশাককে সমর্থন করেন এবং মানববন্ধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী। মানববন্ধনের দুটি ব্যানার ছিলো ছোট পোশাক পরে বিপরীত লিঙ্গকে সিডিউস করা বন্ধ করুন’ এবং ‘ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়।’
তখন মানববন্ধনকারীদের বক্তব্য ছিল‘স্বাধীনতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণ করা খুবই উদ্বেগজনক।’ মানববন্ধনকারী অন্য এক শিক্ষার্থী বাকস্বাধীনতার সঙ্গে পোশাকের তুলনা করে বলেন, বাকস্বাধীনতা যেমন অন্যকে গালি দেয়া নয়, তেমনি পোশাকের স্বাধীনতা মানে পাবলিক নুইসেন্স বা গণ-উপদ্রব বা বিরক্ত করা নয়।
পাবলিক প্লেসে পশ্চিমা সংস্কৃতি চর্চার তীব্র নিন্দা করেন এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, অশালীন পোশাকের মাধ্যমে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে কাউকে ধাবিত করার অধিকার কারও নেই, যাকে মানসিক নির্যাতন হিসেবে দাবি করেন এই শিক্ষার্থী।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নামকরা বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানববন্ধন করে আদালতে সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানানো হয়।
তারা আদালতকে অভিবাদন জানান এবং পশ্চিমা অপসংস্কৃতি চর্চাকারীদের আদালতের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনতে আহ্বান করেন। অপসংস্কৃতির আমদানিকারকদের বিচারের দাবি করেন। কিন্তু সর্বত্র এ মানববন্ধন কর্মসূচি প্রকাশের পর বিক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু শিক্ষার্থী।
আদালতের এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই যেমন সাধুবাদ জানিয়েছেন, তেমনি ফুঁসে উঠেছেন এর বিরোধিতাকারী পশ্চিমা সংস্কৃতির খাটো পোশাককে অশ্লীলতা নয়, পোশাক স্বাধীনতা দাবি করা গোষ্ঠী।
তারা আদালতের সিদ্ধান্তকে নারীদের জন্য অবমাননাকর বলেছেন। আবার অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে নারীবিদ্বেষী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাই পোশাক বিতর্কে এখনও উত্তাল রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া, চলছে তর্ক-বিতর্ক।
বাঙালি সংস্কৃতি সভ্য ও শালীন। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিমা অপসংস্কৃতির প্রবেশ ঘটলে নারীদের জন্য চলাফেরা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। নারীদের যেমন যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি পুরুষ সমাজের মাঝে অনৈতিক ও বেপরোয়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা নারী-পুরুষ সৃষ্টিগতভাবে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
পশ্চিমা দেশগুলোয় অবাধে অনৈতিক সম্পর্কের সমর্থন থাকায় আপত্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় না তেমন। তাদের সংস্কৃতিই এমনভাবে গড়ে উঠেছে। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিমা অপসংস্কৃতির কোনো মিল নেই। তাই তাদের পোশাকও বাঙালি সংস্কৃতিতে অবাধে অনুসরণ করার সুযোগ নেই।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিসেবে বাঙালি সংস্কৃতিতে পোশাকে শালীনতা রাখা সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবি। অন্যান্য ধর্মে কোথাও অশালীনতার সমর্থন নেই।
বিক্ষোবকারীদের যুক্তি একসময় নানি-দাদি বা মায়েরা ব্লাউজ ব্যতীত শাড়ি পড়তেন, যা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু সে সময় তারা জনসম্মুখে এমনভাবে চলাফেরা করতেন না।
শাড়ির আঁচলে শরীরকে ঢেকে রাখতেন। তখন কাপড়ের সংকট ছিল। লোকসমাগমের বাইরে অন্তরালে থাকতেন এমনভাবে। এটা কখনো অশালীনতা চর্চার যুক্তি হতে পারে না।
কিছু কিছু অশালীন সংস্কৃতি এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির ভিডিও অনুসরণে বাঙালি সংস্কৃতিতেও যার প্রভাব পড়েছে। অশ্লীলতার প্রবেশ ঘটেছে দেশের সংস্কৃতিতে, যার কারণে পাল্টে গেছে দৃষ্টিভঙ্গি। পরিবর্তন এসেছে মানসিকতায়।
ধর্ষণ এখন প্রায় মহামারির আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। অশ্লীল পোশাক ধর্ষণের একমাত্র কারণ নয়, বরং সহায়ক কারণ। যেখানে দাদা, নানা, চাচা, বাবা, এমনকি আপন ভাই পর্যন্ত ধর্ষকের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ফেলেছে।
তারা অবশ্যই বিকৃত মস্তিষ্ক ও যৌন সন্ত্রাসী। যদিও যৌন সন্ত্রাসীর তুলনায় ভালোর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। যৌন সন্ত্রাসের হাত থেকে বাদ পড়ছে না হিজাব, বোরকা-পরিহিত নারী থেকে শুরু করে ১১ দিনের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধাও। তাই এখন ভালো-মন্দ সবার চোখে হায়েনা দেখার ভয়।
গত ২৫ আগস্ট ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৮৭ শতাংশ নারী জীবনে একবার হলেও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।”
পোশাকের শালীনতা৷ পোশাকের শালীনতা পোশাকের শালীনতা
ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি যেখানে মহামারির মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে পোশাক স্বাধীনতার নামে অশ্লীল-অশালীন খাটো পোশাকে পুরুষতন্ত্রকে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। নারীর অবশ্যই যেকোনো শালীন পোশাক পরার অধিকার রয়েছে।
তারা বোরকা বা হিজাব পড়তে বাধ্য নয়, কিন্তু অশালীনতা বা পশ্চিমা অপসংস্কৃতি কখনও বাঙালি সংস্কৃতিতে পোশাক স্বাধীনতার নামে আবির্ভূত হতে পারে না।
পোশাক নারী হেনস্তার একমাত্র কারণ নয়। এর জন্য দায়ী পুরুষের বিকৃত বা অসুস্থ মস্তিষ্ক। আরও দায়ী পশ্চিমা ভোগবাদী দর্শনের প্রভাব, নারীকে যেখানে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখানো হয়। পুরুষের আত্মসংযমের অভাবও অন্যতম কারণ।
তাই বাঙালি সংস্কৃতিতে অটুট থেকে পশ্চিমা অপসংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির সহায়ক কারণ হিসেবে খাটো পোশাককে বর্জন করতে হবে।
বাঙালি মেয়েদের শালীন যেকোনো পোশাকে চলাফেরার অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে। অশ্লীলতা বা অশালীনতার অপর নাম পোশাক স্বাধীনতা হতে পারে না।
লেখা
আফিয়া সুলতানা একা
শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: afiasultanaaka2020@gmail.com
সকল প্রকার বৃত্তির খবর সবার আগে পেতে আমাদের ওয়েবসাইটি নিয়মিত ভিজিট করুন।
Follow us on
Join our Official Facebook Group
পোশাকের শালীনতা পোশাকের শালীনতা পোশাকের শালীনতা